বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ও চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার বয়স বৃদ্ধির দাবি একদম নতুন কিছু না হলেও সম্প্রতি এনিয়ে আবারও আলোচনা তৈরি হয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে চাকরিপ্রত্যাশীরা এ দাবিতে আন্দোলন করলেও এবার নতুন করে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ ও অবসরের বয়স ৬৫ বছর করতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’ গত পাঁচই সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আবেদন করেছে।
বিষয়টি যেহেতু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিধির আওতার মধ্যে পড়ে, তাই গত ১৮ই সেপ্টেম্বর সেই চিঠি বা প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
কেউ কেউ মনে করছেন, ওই চিঠির প্রেক্ষিতে বয়সসীমা উভয়দিক থেকেই বৃদ্ধি হতে পারে।
সেক্ষেত্রে এই প্রশ্নটি সামনে আসছে যে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো সংক্রান্ত এই নতুন প্রস্তাব বাস্তবায়ন করলে সেটি কি রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সাথে মিলে আরও বোঝা তৈরি করবে?
বয়সসীমা বাড়ানোর যৌক্তিকতাও বা কতটা, সেটি নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন।
বয়সসীমা বাড়ানোর যুক্তি কী?
বর্তমানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর, আর অবসরে যাওয়ার সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫৯ বছর। তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ ও অবসরে যাওয়ার বয়স ৬০ বছর নির্ধারণ করা আছে তাদের জন্য।
শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রেই বয়সসীমা বেশি না। বিশেষ কিছু পেশার ক্ষেত্রেও অবসরের বয়সসীমা বেশি। আর এখানেই বৈষম্য খুঁজে পাচ্ছে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।
যেমন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক (অবসর গ্রহণ) আইন, ২০১২’ অনুযায়ী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর।
সংবিধানের ৯৬ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৭ বছর।
সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন সময় যেসব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের অনেকের অবসরের বয়সও ৬৭ বছরের বেশি বলে সংগঠনটি তাদের চিঠিতে জানিয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক তিন বছর, যা আজ থেকে দুই দশক আগের তুলনায় বেশি।
যারা দাবি তুলে ধরছেন তারা মনে করেন, জীবনকালের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চাকরির বয়সসীমা নির্ধারণ করা উচিৎ।
এ প্রসঙ্গে সংগঠনের সভাপতি মো. আনোয়ার উল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “গড় আয়ু যেহেতু বেড়েছে, সেক্ষেত্রে অবসরের বয়স না বাড়ালে সেখানে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয় থেকে যাচ্ছে।”
যদিও তার এই বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন অনেকে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারের অনেক কর্মী একযোগে পদোন্নতি পেয়েছেন। এর অন্যতম কারণ, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অনেকে নিয়মিত পদোন্নতি পাননি।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বঞ্চিত থাকা সেই সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষতিপূরণ করার জন্য বয়সসীমা বৃদ্ধির এই দাবি জানানো হচ্ছে কি না জানতে চাওয়া হয়েছিল আনোয়ার উল্লাহ’র কাছে।
উত্তরে তিনি বলেন, “এটা মনে করার কারণ নাই যে বঞ্চিতদের সুযোগ দেওয়ার জন্য এটা হচ্ছে। কারণ যাদের পদোন্নতি হচ্ছে, তাদের বেতন বাড়বে না খুব বেশি। শুধু কর্মকাল বাড়বে।”
বয়সসীমা বৃদ্ধির বিপক্ষে যত যুক্তি
আনোয়ার উল্লাহ যদিও বলছেন যে চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি করলে বেতন-ভাতা বা খরচ খুব বেশি বাড়বে না।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বয়সসীমা বাড়ালে সরকারের ব্যয় তো বাড়বেই। সেই সাথে প্রশাসনের কার্যক্রমেও অনেক জটিলতা তৈরি হতে পারে।
যারা বছরের পর বছর চেষ্টা করেও সরকারি চাকরিতে যোগদান করতে পারেননি বা যাদের সরকারি চাকরির বয়সসীমা প্রায় শেষের দিকে বা রাজনৈতিক কারণে যারা সরকারি চাকরির বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, বয়সসীমা বাড়ানোটা আপাতদৃষ্টিতে তাদের জন্য একটা সুযোগ।
কিন্তু যারা নতুন করে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিবে, তারা অসম প্রতিযোগিতার মাঝে পড়ে যাবে।
অর্থনৈতিকভাবেও সরকারকে ‘দীর্ঘমেয়াদে চাপের মুখে পড়তে হবে’ বলে মনে করছেন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি’র ডিস্টিংগুইশড ফেলো অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান।
“অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর ইমিডিয়েট এবং মিডিয়াম লং টার্ম ইফেক্ট আছে। অবসরের সময় বাড়ালে পেনশনের চাপটা বিলম্বিত হবে। কিন্তু যখন দিতে হবে, তখন আরও বেশি দিতে হবে,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশের বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতার পেছনে।
চলতি অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮১ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। তার আগে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৭৭ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা।
সেক্ষেত্রে অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর প্রস্তাব মেনে নিলে সরকারকে এ খাতে বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি সংক্রান্ত আরেকটি জটিলতার জায়গা হলো বেকারত্ব।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস-এর হিসেবে বাংলাদেশে এখন বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। যদিও বাস্তবে সংখ্যাটা আরও বেশি বলেই মত অর্থনীতিবিদদের।
এছাড়া, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিআইডিএস-এর তথ্যানুযায়ী, দেশে বেকারত্বের হার তিন দশমিক ছয় শতাংশ। এর মধ্যে যুব বেকারত্বই প্রায় ৮০ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের তরুণদের সরকারি চাকরির প্রতি ঝোঁক এখন বেশি। চাকরিতে প্রবেশের বয়স আরও বৃদ্ধি করা হলে এই বিশাল কর্মক্ষম তরুণদের অনেকে ‘একদিন না একদিন সরকারি চাকরি হবে’ আশায় শেষ পর্যন্ত চাকরির প্রস্তুতি নিবে।
ফলে, একটা দীর্ঘসময় পর্যন্ত এই তরুণদেরকে কাজে লাগানো যাবে না বিধায় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যদিও অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান এও মনে করেন, “সবাই সরকারি চাকরির আশায় বসে থাকে না। একটা চাকরির পরীক্ষা দিয়ে চাকরি না হলে তারা অন্য কোথাও হয়তো কাজ করে।”